প্রাপ্তির অপ্রাপ্তি – প্রেমের দুঃখের গল্প: বাসর ঘরে বসে আছি আমি। আজ আমি মিসেস এলিজা লিনোর মাহমুদ চৌধুরী। একটু আগেও আমি মিস ছিলাম। ছিলাম বাড়ির মেয়ে। আর এখন আমি কিছু সময়ের ব্যবধানে মিসেস হয়ে গেলাম।
আহহ….।
এই কে কাগজ দিয়ে ঢিল ছুড়লো রে?
ক্লাস রুমে বসে আছি। ক্লাস থেকে স্যার চলে যাওয়ার সাথে সাথেই পিঠে একটা কাগজের ঢিল এসে লাগে। পেছনে তাকিয়ে দেখি আমার বজ্জাত হিরো দরজায় দাঁড়িয়ে মুচকি মুচকি হাসছে। ওর হাসি দেখে আমিও মনে মনে হেসে ফেললাম। কি সুন্দর করেই যে হাসে ও।
ওর হাসি দেখে প্রতিবার ক্রাস খাই আমি। বজ্জাত টা হাতের ইশারা করে ডাকছে আমায়। কিন্তু আমি তো এখন যাবো না মিস্টার। আপনি যতোই ডাকেন। নিজে ক্লাস বাদ দিয়ে ঘুরাঘুরি করবে আর আমাকেও করতে দিবে না। অবশ্য আমার আশেপেশেই ঘুরঘুর করে। যতক্ষণ আমায় দেখে ততক্ষণ ই নাকি তার নিশ্বাস ঠিক করে নিতে পারে। পাগল একটা।
জোহান ডাকার পর আমি আরো একটা ক্লাস করে বের হয়েছি। ওহ বলাই তো হয়নি। ও হচ্ছে জোহান। আমার প্রেম.. আমার আত্মা… আমার ভালোবাসা ..আমার দুনিয়া। জোহান অনার্স ফাইনাল ইয়ার এ কেমেষ্টি ডিপার্টমেন্টে পড়ে। আমি এলিজা। অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে ইকোনোমিক্স ডিপার্টমেন্টে পড়ি। জোহান আর আমি একি কলেজে পড়ি।
আমি ক্লাস থেকে বের হয়ে হাটতে থাকি। একটু পর দেখি জোহান ও আমার পাশে হাটছে। ও যখন আমার পাশে হাটে তখন শুধু মনে হয় এই পথ যদি না শেষ হয়।
~ তবে কেমন হতো তুমি বলোতো?
~ এইই তুমি আমার মনের কথা শুনতে পাও নাকি?
~ কই নাতো। আমি তো মনে মনে গান গাইছিলাম তাই প্রথম লাইনের পরের লাইনটা তোমায় শোনালাম আর কি। তুমিও বুঝি এই গানটিই গাইছিলে?
~ হুহ ডং।
~ ওহ তাই বুঝি। আজ কিন্তু একজন আমার দেওয়া পায়েল টা পড়ে এসেছে। অসম্ভব সুন্দর লাগছে।
~ তো মিস্টার তুমি কি আমার আগা গোড়া খেয়াল করো নাকি? আমার সেলোয়ার দিয়ে তো পায়েল ঢাকা।
আমার কাছে এসে চশমাটা চোখ থেকে একটু নামিয়ে
~ তো অন্য কাউকে খেয়াল করবো বুঝি?
জোহান আগে আগে যাচ্ছে। আমার তো রাগ হলো একটু.. বেশি না তেমন। কারন আমি জানি অন্য কোন মেয়ের দিকে কখনোই তাকাবেনা। তবুও জোরে জোরে বললাম, করেই দেইখো না.. গলা টিপে মেরে ফেলবো একদম।
জোহান হাসতে হাসতে সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেল।
কতো গুলো সীট ফটোকপি করে নিলাম। দোকান থেকে বের হয়ে দেখি কলেজের সামনে রিকশায় বসে বাদাম চিবোচ্ছে আমার হিরো। আমি পাশে যেতেই সিটি বাজিয়ে বললো
~ আমার নায়িকা কি আমার পাশে বসে রিকশায় হাওয়া খাবে না? হেসে দিলাম আমি। রিকশায় উঠে বসে বললাম
~ হাওয়া খেতে খেতে বাসায় যাবো।
জোহান আমার দিকে তাকিয়ে বললো
~ নায়িকার বাসার আগেই নেমে যেতে হবে। নইত নায়িকার বড়ো লোক বাবা আমার কোমড় ভাঙবে। আরো হাসি পেলো আমার। তেমন হাসলাম না। জোহান আমার দিক একটু মুখটা এগিয়ে বললো
~ তোমার ঐ চিরল দাতের হাসি বড্ড ভালোবাসি।
~ আহা কি রোমান্টিক। বাদাম খাবো। হা..।
জোহান বাদাম ছিলে আমাকে খাইয়ে দিয়ে থাকে। আর আমি চিবুতে চিবুতে হাওয়ায় কেশ উড়িয়ে একরাশ ভালোলাগা নিয়ে রিকশায় বসে থাকি।
বাসার একটু সামনে আসতেই জোহান রিকশা মামাকে বলে, মামা দাঁড়াও। রিকশা মামা রিকশা থামায়। আমার দিকে তাকিয়ে জোহান বলে
~ হৃদহরিনী আপনার বাসার কাছাকাছি এসে গেছি। এবার বিদায় দেন আমাকে। আপনার পিতা দেখিলে যে প্রবলেম হইবে।
~ সাবধানে বাসায় যেও আমার প্রাননা। গিয়ে আমাকে টেক্সট করিতে ভুলিও না।
~ যথা আজ্ঞা।
রিকশা মামার দিকে তাকিয়ে বললো
~ এই মামা.. সোজা ডান পাশ দিয়ে চলে যাও। একদম বাসার গেইটে নামিয়ে দিবা। আবার গলির সামনে নামিয়ে দিও না যেন।
রিকশা আলা মামা ~ আইচ্ছা।
রিকশা থেকে নেমে ডাইরেক্ট বাসায় ঢুকে পড়লাম। আম্মু দরজা খুলে দিল। ভিতরে ঢুকে দেখি ড্রয়িং রুমে পাপা কার সাথে বসে যেন কথা বলছে। বললে বলুক আমার কি? আমার পাপা নেতা মানুষ। কতো লোক যে এ বাসায় এসে এভাবে পাপার সাথে আলোচনা করে বলাই বাহুল্য। ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে রুমে চলে এলাম। ব্যাগ রেখে আলমারি থেকে কাপড় নিয়ে ওয়াশ রুমে চলে গেলাম। সুন্দর করে একটা সাওয়ার নিয়ে চেঞ্জ করে বেরিয়ে এলাম।
রুমে দেখি পানি নেই। পানি খাওয়ার জন্য ডাইনিং রুমে এলাম পানি খেতে। ফট করে সামনে এসে একজন দাঁড়িয়ে পড়ল। এই লোক তো পাপার সাথে কথা বলছিল। মুখের দিকে তাকিয়েই আমার আত্মা শুকিয়ে গেলো। সামনে স্বয়ং লিনোর মাহমুদ চৌধুরী দাঁড়িয়ে। অনেক বড় ক্ষমতাশালী লোক উনি। কিন্তু ইনি জোকের মতো আমার পিছু লেগেছেন। আজ দেখি বাসায় এসেছেন।
একদিন…
উনি এক্সিডেন্ট করে হালকা চোট পান। গাড়ি রেখে ফুটপাতে এসে দাড়ান। হাত থেকে রক্ত বেরোচ্ছিলো খুব। আর পায়ের চামড়াও ছিলে গেছে। উনি হাত বার বার চেপে ধরে রক্ত পড়া কমানোর চেষ্টা করছেন। আমি তখন সেই রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলাম। হটাৎ সামনে দেখি একটা লোক দাঁড়িয়ে উশ হাস করছে। আর তার হাত থেকে রক্তের ছিটে বের হচ্ছে। আমি এগিয়ে গেলাম লোকটির দিকে। দুপুরের কাঠ ফাটা রোদে কাওকেই সামনে পেলাম না। শুন শান নিরব জনমানবহীন এলাকা।
আমি কাছে গিয়ে বললাম, কিভাবে হলো আপনার এরকম?
উনি আমার দিকে না তাকিয়েই বললো, লিটিল এক্সিডেন্ট করেছি। আশে পাশে কোন হসপিটাল অর ফার্মেসিও নেই। প্লিজ হেল্প মি।
আমার খুবই মায়া হলো লোকটার উপর। কিভাবে আহতো হয়ে কষ্ট পাচ্ছে। আহারে বেচারা।
আমি উনাকে পাশেই একটা গাছের গুড়ির উপর বসতে বললাম। উনি বসলেন। আমিও গিয়ে উনার সামনে বসলাম। ব্যাগ থেকে মাম পট টা বের করে উনার হাতের রক্ত ধুয়ে দিলাম।
পানির ছোয়ায় হয়তো জালা করছিল তাই দেখলাম উনি দাতে দাত লাগিয়ে শক্ত করে রেখেছেন। তারপর বক্স থেকে এ্যন্টিসেপটিক বের করে লাগিয়ে দিলাম। ব্যান্ডেজ দিয়ে কোন মতে বেধে দিলাম। আমি আবার এতো ভালো ব্যান্ডেজ করতে পারি না। আর এই সব আমার ব্যাগে অলটাইম থাকে। আমার আম্মু এগুলো ঢুকিয়ে দেন। কখন কী জানি হয় বলাতো যায় না। এইযে আজ এই লোকটার উপকার হলো।
আমি উনার দিকে তাকিয়ে দেখি উনি একনজরে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। অদ্ভুত সেই দৃষ্টি। আমার অসস্থি লাগল একটু। আমিই বললাম, ব্যথা কি খুব বেশী করছে? উনি আমার জবাব না দিয়ে বললেন, নাম কি তোমার? আমি বললাম, এলিজা খান। উনি নিজে থেকেই বললেন, আমি লিনোর মাহমুদ চৌধুরী। উনার নাম শুনে আমি চমকে উঠলাম। এই নাম তো আমি শুনেছি আগে। বেল পাওয়ার ফুল লোক। ইনিই তাহলে উনি।
উনি আমাকে চমকে দিয়ে বলে, এলিজা বাসায় যাও। আর বাসায় গিয়ে তোমার বাবাকে আমায় কল দিতে বলবে। আমিও বাসায় এসে পাপাকে উনাকে কল দিতে বলেছিলাম। পাপা ফোন দিয়েছিল কিনা জানি না। তবে এই লোকটা লোক দিয়ে প্রায়ই আমার জন্য টেডি, লাভ লেটার এই সব পাঠায়। মাঝে মাঝে দেখি রাস্তায় ও দাঁড়িয়ে থাকে।
আমার দিকে তাকিয়ে বললো, আই লাভ ইউ।
ও আমার আল্লাহ, এই লোক এতোদিন লেটার দিয়েছে আর এখন বাসায় এসে সরাসরি কোন ভনিতা ছাড়াই বলে দিলো। এখন আমি কি বলি? উনাকে কি বলবো আমি অন্য কাউকে ভালোবাসি?
আআমি আসলে আপনাকে ভালোবাসতে পারবো _
তখনি পাপা ডাক দিলো, লিনোর বাবা এদিকে আসো। তোমার আন্টির সাথে পরিচিত হও।
~ আসছি আংকেল।
উনি যেতে যেতেই বললেন, তোমাকে নরমাল ড্রেসেই বেশি সুন্দর লাগে।
মাথা ঘুরতেছে। এইগুলা কোন উটকো ঝামেলা এসে জুড়লো আমার কপালে।
রাতে হেড ফোন কানে দিয়ে ফুল সাউন্ডে গান শুনছি আর আমার বজ্জাত হিরো টার সাথে চ্যাট করছি। তখন আম্মু এসে আমাকে ইশারায় ডেকে নিলেন। আমি ফোন রেখে হেড ফোন খুলে আম্মু পাপার রুমে এলাম। দেখি পাপা শুয়ে আছে আর আম্মু পাশে দাড়িয়ে আছেন। আমি ইশারা করতেই আম্মু বললেন, তোর পাপা তোর সাথে কথা বলবে।
পাপা আমাকে দেখে উঠে বসলেন। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, এখানে বসো। আমিও বসলাম।
তারপর পাপা শুরু করলেন
“দেখো এলিজা তুমি বড়ো হয়েছো। আমাদের এখন উচিত তোমার বিয়ের ব্যবস্থা করা। এসময় টানের সময়। এই বয়সে মেয়েদের বিয়ের জন্য জোর থাকে বেশি। তাই আমরা তোমাকে বিয়ে দিতে চাই। তুমি দেখেছো আজ বাসায় লিনোর মাহমুদ চৌধুরী এসেছিলেন। উনার সাথে পরিচিত থাকলেও তেমন সুসম্পর্ক ছিল না আমার। উনি অনেক বড় মাপের মানুষ।
প্রচুর ক্ষমতাশালী। মন্ত্রীদের সাথে উঠা বসা উনার। তোমার মাধ্যমেই আমার সাথে সুসম্পর্ক হয়েছে উনার। উনি তোমাকে পছন্দ করেন। তোমাকে বিয়ে করতে চায়। উনার মতো একজন তোমাকে বিয়ে করতে চায় এইটা আমাদের বড় সৌভাগ্য। লিনোরের সাথে এই নিয়ে কথা বললাম। ও আমাকে জানালো তুমি চলন বলন নাকি সুবিধার না। তাই কয়েকদিনের মধ্যেই তোমাকে বিয়ে করতে চায়।
কিন্ত পাপা আমি _
“দাঁড়াও। আমি তোমার মতামত জানতে চায় নি। তুমি ভালো করেই জানো আমি যেহেতু ঠিক করেছি সেহেতু তোমাকে ওখানেই বিয়ে করতে হবে। কি নেই বলো লিনোর মাহমুদ চৌধুরীর। বাড়ি, গাড়ি, অর্থ, সম্পদ, ক্ষমতা সব আছে। তুমি রাজ রানী হয়ে থাকবে। ওর সাথে বিয়ে হলে আমার জায়গাটা কোথায় হবে ভাবতে পেরেছো তুমি? আমার মান সম্মান কতো উপরে উঠে যাবে। সামনের ইলেকশনেও দাঁড়াবো ভাবছি। যাও ঘরে যাও আর তোমার আম্মুর কাছ থেকে লিনোরের নাম্বার নিয়ে যেও। নতুন জীবন শুরু করো আর সুখী হও।”
এবার আমি কি করবো? লিনোর কে যে কিছুতেই বিয়ে করতে পারবো না। আমি যে জোহান কে ভালোবাসি। পাপাকে বলতেই হবে।
“পাপা আমি এই বিয়ে করতে পারবো না। আমি জোহানকে ভালোবাসি।”
পাপার দিক তাকিয়ে থাকতে পারলাম না। আমার কথা শুনা মাত্রই পাপার চেহারা পুরো লাল হয়ে গেছে। তবুও নিচ দিকে তাকিয়ে বলতে থাকলাম।
“পাপা জোহান ও আমাকে ভালোবাসে। ও আমার কলেজেই পড়ে। ফাইনাল ইয়ারে। কেমিস্ট্রি বিভাগে।”
“হুম। বাসা কোথায়?”
“কলেজের পাশেই”
“বাসায় কে কে আছেন?”
“ওর মা আর ওর চাচাতো বোন। বাবা নেই”
“সংসার চলে কিভাবে?”
“ওর বাবার পেনশনের টাকায়।”
“হুম ব্যবস্থা করছি আমি। যাও ঘরে যাও”
চলে এলাম আমি নিজের রুমে। পাপাতো বললো ব্যবস্থা করবে। কি করবে পাপা? কথা বলবে
পর্ব ১
Comments
Post a Comment